আকাশ ছোঁয়া মেঘেদের বাড়ি [ Meghalay ,Home of Clouds ]

“ওই দেখো বৃষ্টিধারা আসিয়াছে নেমে
 পর্বতের ' পরে ;  অরন্যেতে ঘনঘোর
 ছায়া  ; নির্ঝরিনী উঠেছে দূরত্ব হয়ে ;
 কলগর্বে উপহাসে তটের তর্জন 
করিতেছে অবহেলা’’
মাওজঙ্গিহ ল্যাপিনশংডোর ( Mawjngih Lapynshongdor ) ছেড়ে গাড়িটা তখন ডান দিকে বাঁক নিচ্ছিল আর আমি অর্ধেক খোলা জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে আশেপাশে কোনো চিত্রাঙ্গদা কে খোঁজার চেষ্টা করে চলেছিলাম। মনিপুরের অরণ্যে সেদিন অর্জুন চিত্রাঙ্গদা ঠিক কতটা মুগ্ধ হয়েছিল জানিনা কিন্তু মেঘালয় মালভূমির অপরূপ সৌন্দর্য আমায় বাক্যবাগিশ করে ছাড়লেও এই সৌন্দর্য বর্ণনা করতে তাদেরই শরণাপন্ন হলাম। 

অনেক ছোটবেলাতেই বাবার কাছে শুনেছি এমন জায়গা আছে যেখানে মানুষ মেঘের ভেতর দিয়ে হেঁটে যায়, ঘরের জানলা দিয়ে মেঘ ঢুকে আসে।  বহুবার ছাদে উঠে বড় লাঠি দিয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা করেছি মাথার উপর দিয়ে ভেসে যাওয়া মেঘেদের। তখন পারিনি, কিন্তু এবার, এত বছর পর আমি এসেছি সেই মেঘের রাজ্যে, মেঘালয়ে। আমাদের গাড়িটা ডিউলেহি (Dewlehi Village)গ্রামকে বাঁদিকে রেখে ছুটে যাচ্ছিল চেরাপুঞ্জির ( Cherrapunji ) দিকে। যেভাবে মাঘ মাসের সরস্বতী পুজোর চাঁদা তোলার জন্য কচিকাঁচারা পথচলতি মানুষটাকে ঘিরে ধরে সেভাবেই একদল ঘনমেঘ এসে ঘিরে ধরলো আমাদের। গাড়ি থামিয়ে আমিও নেমে গেলাম মেঘেদের দলে শামিল হতে। ইতিমধ্যেই পিছনে ফেলে আসা খাড়া পাহাড়গুলোর ঢাল বেয়ে আরো মেঘেরা এলো দলে দলে। ডানদিকের পাহাড়ের বাঁক দিয়ে ভেজা ভেজা পিচের রাস্তা চলেছে সামনের পাহাড়ের দিকে।   সেখানেই দেখা যাচ্ছিল  বেশকিছু ঘর বসতি। তবে সেগুলো ঢাকা দিয়ে দিল আরো মেঘেদের দল । চারিদিকে কেবল সাদা আর সাদা মেঘের আনাগোনা । ভালই লাগছিল বেশ । ছোটবেলায় ভাবতাম মেঘের ভেলায় বুঝি চড়া যায় , তবে বাস্তবে চড়তে না পারলেও মেঘের শীতল কোমল ছোঁয়া পেয়ে মনটা ভরে গেল । গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহের পর শ্রাবনের ঘন বর্ষণে যেরকম সোঁদা গন্ধ ভেসে আসে। ঠিক তেমনি খাসি পাহাড়ের মেঘের দল এক অদ্ভূত গন্ধে মাতিয়ে রেখেছে চারিদিক। ক্ষণে ক্ষণে ঝিরিঝিরি হাওয়ার সাথে ভেসে আসছে দূর পাহাড় থেকে অর্কিড ফুলের সুবাস । এতসব আয়োজন এর মাঝেও একটু সন্তর্পনে কান পাতলে পরিষ্কার শুনতে পাওয়া গেল জলের শব্দ । টের পেলাম এক জলপ্রপাত এর উপস্থিতির । 

মাথার পিছনে একটা ঠান্ডা স্পর্শ পেয়ে ফিরে দেখতেই দেখলাম সব মেঘ যেন হারিয়ে গেছে নিমেষে। সামনে পাহাড় গুলো কেমন যেন আকারে পাল্টে গেছে। উঁচু-নিচু ঢালের পাশ দিয়ে বিস্তীর্ণ ঘেসো উপত্যকা ধরে দ্রুত পায়ে হেঁটে আসছে কা লিকাই। খাসি অধিবাসীদের নিয়ে এক বড় বিড়ম্বনা কিছুতেই বুঝতে পারি না কে মেয়ে আর কেইবা মহিলা । কথায় বলে নারীর বয়স জানতে নেই আর এক্ষেত্রে জানা সম্ভব নয় । সামনের দুটো বাড়ির পরে উঁচু জমির ওপর ঘর লিকাইয়ের। ঘরে পৌঁছে আজ তার অবাকই লাগে । মেয়েটা ঘরে নেই, দ্বিতীয় পক্ষের স্বামী আজ তার জন্য আগে থেকেই খাবার তৈরি করে রেখেছে। জিজ্ঞেস করাতে লিখে জানতে পারে মেয়ে গেছে খেলতে। আসলে লিকাই জানে দ্বিতীয় পক্ষের স্বামী আগের পক্ষের মেয়েটিকে ভালো চোখে দেখে না। তবুও  সে আর চিন্তাভাবনা না করে খাবার শেষ করে। খাবার শেষে উঠে যাওয়ার সময় হঠাৎ ঘরের কোণের সুপারির ঝুড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠে সে দেখে কয়েকটা কাঁটা আঙুল । চিনতে ভুল হয়না তার। এ আঙুল তার মেয়ের । অসহনীয় কষ্ট ও অনুশোচনায় লিকাই ছুটে বেরিয়ে যায় খাড়া পাহাড়ের দিকে ...

ঘোর ভাঙলো আশেপাশের মানুষের কোলাহলে । মেঘ সরে গেছে। পরবর্তী মেঘের দল বেশ খানিকটা দূরে। তাই চারিদিক পরিষ্কার, আশেপাশে অনেক ছোট-বড় দোকানপসার কোনোটাবা খাবারের আবার কোনোটা নিতান্তই সৌখিন সামগ্রীর সমাহারে । আর ঠিক উল্টো দিকেই খাড়া পাহাড়ের খাতে ঝরে পড়ছে, নোহ-কা-লিকাই (Noh-Ka-Likai)। কি অপূর্ব সেরূপ – 
“ কি আনন্দ কিরণ এতে প্রথম প্রত্যুষে 
অন্ধকার মহান সৃষ্টিশতদল 
দিগ্বিদিকে উঠেছিল উন্মেষিত হয়ে 
এক মুহূর্তের মাঝে । ... যেমনি দেখিনু চেয়ে
সেই সুর সরসীর সলিলের পানে,

অমনি পড়িল চোখে অনন্ত অতল।
স্বচ্ছ জল যত নিম্নে চাই। ...মনে হল ভগবান
সূর্যদেব অঙ্গুলি নির্দেশিয়া
দিলেন দেখায়ে, জন্মশ্রান্ত কর্মক্লান্ত 
মর্ত্যজনে, কোথা আছে সুন্দর মরণ
অনন্ত শীতল। সেই স্বচ্ছ অতলতা
দেখেছি তোমার মাঝে। চারিদিক হতে 
দেবের অঙ্গুলি যেন দেখায় দিতেছে
মোরে, অলোক-আলোক-মাঝে
কীর্তিক্লিষ্ট জীবনের পূর্ণ নির্বাপণ।’’

ঘুরে ফিরে আবার চলে এলো চিত্রাঙ্গদা। আমিও সত্যি জানিনা কিভাবে চিত্রাঙ্গদার সৌন্দর্য মিলে মিশে যাচ্ছে এই নোহ-কা-লিকাইয়ের সাথে। তবে এটুকু জানি সব অনুভুতিকে যুক্তি দিয়ে সাজানো বড়ই কঠিন। খাসি ভাষায় ‘নোহ' র অর্থ হল ঝাঁপিয়ে পড়া । অনুশোচনা, দুঃখ আর কষ্টে উন্মত্ত প্রায় কা লিকাইয়ের গিরিখাতে ঝাঁপিয়ে পড়ার থেকেই এই জলপ্রপাতের নামকরণ। এত সৌন্দর্যের মাঝেও যেন তাই বারবার ঘুরেফিরে আসে সেই বহু যুগ আগে ঘটে যাওয়া কষ্টের কাহিনীটা। তাই যতই বৃষ্টি কম হোক এই জলপ্রপাতের জল ফুরিয়ে যায় না, হয়তো হাহাকার মেশানো সেই মায়ের চোখের জলটাই ঝরনা হয়ে নেমে আসে গিরিখাতের বুকে।

আরও পড়ুন  -
ডাউকি-তামাবিল: বাঙালীর এপার-ওপার [ Dawki-Tamabil, Border of Friendship ]

ভিডিওতে মেঘালয় ভ্রমণ  -

Post a Comment

6 Comments

  1. অসাধারণ👍 পরেরটার অপেক্ষায় রইলাম

    ReplyDelete
  2. উফ সেরাই তো! পুরোটা পড়ে আরও ভালো লাগল। :)

    ReplyDelete