“ ডিম আগে না মুরগি আগে ?” এই ধাঁধা আমাদের সবার খুব পরিচিত । সবার মত আমিও ছোট থেকেই এই ধাঁধা প্রশ্নের বাণে বিব্রত হয়েছি । তার পর একসময় পিঠ বাঁচানো উত্তর বারও করেছি তবে আজ এতদিন পরে এসে আমার মনে হয়েছে ধাধাটা ঠিক যেভাবে আমরা ভাবি পুরোটা সে ভাবে না ভাবলেই সমাধান টা সহজ হয়ে যায় । তাহলে আর ধাঁধার উত্তরে হ্যারি পটারের লুনা গার্ডের মত বলতে হবে না – “ Well then , I think the answer is that a circle has no beginning.” তবে কথা হল এতটাই সহজ হলে সেই যুগের মহান দার্শনিক অ্যারিস্টটল কেন বলেছিলেন যে – “If there has been a first man he must have been born without father or mother – which is repugnant to nature. For there could not have been a first egg to give a beginning to birds, or there should have been a first bird which gave a beginning to eggs; for a bird comes from an egg.”
কারন একটাই অ্যারিস্টটলের কালে বিবরতনবাদের ধারনা ছিল না ।
কোনটি আগে ? মুরগি নাকি ডিম ( যে কোন ডিম ) ?এই ক্ষেত্রে পরিস্কারভাবেই বলা যায় যে ডিম এগিয়ে । কারন বিবর্তনবাদ থেকে আমরা জানি জীব বিবর্তনের হায়ারকিতে সরীসৃপ থেকে এসেছে পাখি । মুরগি যেহেতু একটা পাখি আর সরীসৃপ ডিম পাড়তে সক্ষম তাই সাধারন ভাবেই পাখির সৃষ্টির আগেও ডিম ছিল । এমনকি আরও আগে ডাইনসরদের ডিম পাড়ার কথা আমাদের সবার জানা ।
আবার , কোনটি আগে মুরগি নাকি সেই মুরগি প্রজাতির ডিম ? এর উত্তরে নিশ্চিতভাবেই মুরগি এগিয়ে , কারন মুরগি ছাড়া তার ডিম পাওয়া সম্ভব না ।
সমস্যাটা মুলত এখানেই, এই প্রশ্ন ও পাল্টা প্রশ্নউত্তরের বেড়াজালে ধাঁধার অর্থ ঘেঁটে ঘ । আমার কাছে কিন্তু আসলে ধাঁধাটা মুরগি বা পাখি আর ডিম নিয়ে না । একটু গভীরে ভাবলেই দেখা যাবে এখানে জানতে চাওয়া হয়েছে জীবনের সৃষ্টির আদি রহস্য । অর্থাৎ প্রথম জীবটা কি থেকে সৃষ্টি হল !
এই জীবসৃষ্টির গবেষণাতে উঠে আসা একটি জনপ্রিয় মতবাদ হল “জৈবরাসায়নিক মতবাদ” । এই মতবাদে বলা হয় 3.7 মিলিয়ন বছর আগে জড়বস্তু থেকে রাসায়নিক উপায়ে প্রানের সৃষ্টি হয়েছিল । তারপর আদি প্রান থেকে অভিব্যাক্তির মাধ্যমে আসে বিভিন্ন জীব । বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার আই ওপারিনের মতে , আদিম পৃথিবীতে সমুদ্রের জলে অ্যামাইনো অ্যাসিড , প্রোটিন ইত্যাদির পরিমান ছিল পর্যাপ্ত । সৌরবিকিরন , ত্বড়িতঝটিকা , তাপশক্তি , মহাজাগতিক রশ্মি ইত্যাদির প্রভাবে বিক্রিয়ার মাধ্যমে ক্ষুদ্রক্ষুদ্র অনুর সৃষ্টি হয় । বিজ্ঞানী জে বি এস হ্যালডেন এই ক্ষুদ্র অনু ও সমুদ্রের জলের মিশ্রণকে বলেন “ হট ডায়ালুট স্যুপ’ । ওপারিন বলেন এই তরলেই সৃষ্টি হয় লিপিড , প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেট নির্মিত কোশ স্বত্তা , কোয়াসারভেট । যদিও বর্তমানে কোয়াসারভেট মডেল গৃহীত হয় না । পরবর্তীকালে বিজ্ঞানী এস ডব্লিউ ফক্স মাইক্রস্ফিয়ার মডেলের ধারনা দেন । যেটি অনেকটা কোয়াসারভেটের মত হলেও এটিতে লিপিড বা কার্বোহাইড্রেটের অস্তিত্ব নেই । প্রাচীন শিলাতে এটির অস্তিত্বের নিদর্শন পাওয়া যায় । অর্থাৎ একটা বিষয় ধরে নেওয়ায় যায় যে জীব সৃষ্টির দৌড়ে ডিম বা কোশ এগিয়েই আছে ।
কথা প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে এই জীবন সৃষ্টির রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করা আছে বিভিন্ন প্রাচীন মাইথোলজিতেও । যেমন মিশরীয় মাইথলজি অনুসারে – সবকিছু সৃষ্টির আগে ছিল না কিছুই । না ছিল আলো , না ছিল আকাশ , বাতাস , মাটি , এমনকি শব্দ পর্যন্ত না । ছিল শুধু জল , সীমাহীন জল , যার নাম ছিল ‘নান’ । একদিন এই জলেই ভেসে উঠলো একটি ডিম । তারপর এক সময় চিড় ধরল সেই ডিমে , সৃষ্টি হল প্রথম শব্দের । তারপর এই ডিম থেকে বেরোল একটি মাটির ঢিপি যার উপরে বসে এক পুরুষ , প্রথম দেবতা , আতুম ।
আবার মৎস্যপুরাণে বলা হয়েছে - মহাপ্রলয়ের পরে চারিদিকে যখন শুধুই অন্ধকার তখন সৃষ্টি হয় একটি ডিমের যার নাম ‘হিরণ্যগর্ভ’। এর থেকেই জন্ম নেন ‘স্বয়ম্ভূ’ অর্থাৎ ‘ ব্রহ্মা’ ।
এভাবেই বিভিন্ন দেশের কল্পকাহিনীতে পাওয়া যায় সৃষ্টির আদিরহস্য উদঘাটনের প্রচেষ্টা , যা পড়লে বেশ অবাক হতে হয় । তবে বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংসের মত আমিও জীব সৃষ্টির এই দৌড়ে ডিমকেই এগিয়ে রাখি ।
0 Comments