"আমি প্রতি মুহূর্তে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে বোঝাব যে, It is not an imaginary story, বা আমি আপনাকে সস্তা আনন্দ দিতে আসি নি। ...যা দেখছেন তা একটা কল্পিত ঘটনা, কিন্তু এর মধ্যে দিয়ে যেটা বোঝাতে চাইছি আমার সেই থিসিসটা বুঝুন, সেটা সম্পূর্ণ সত্যি। সেটার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই আমি আপনাকে এলিয়েনেট করব প্রতি মুহূর্তে। যদি আপনি সচেতন হয়ে ওঠেন, ছবি দেখে বাইরের সেই সামাজিক বাধা বা দুর্নীতি বদলের কাজে লিপ্ত হয়ে ওঠেন, আমার প্রোটেস্টকে যদি আপনার মাঝে চারিয়ে দিতে পারি তবেই শিল্পী হিসেবে আমার সার্থকতা।"
হ্যাঁ ঠিক এভাবেই ভাবতেন ঋত্বিক ঘটক । অবশ্য শুধু ভাবতেন বললে ভুল হবে । প্রত্যেক চলচ্চিত্রেই তিনি এই বার্তা ফুটিয়ে তুলেছেন অসামান্য দক্ষতায় । সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালীর পরেই যদি কোনো বাংলা সিনেমা সমগ্র বিশ্বে আলোচিত হয় তাহলে সেটি ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত শক্তি পদ রাজগুরুর কাহিনী অবলম্বনে " মেঘে ঢাকা তারা " । সাধারণ বাঙালির মনে একটা ধারণা থেকে গেছে যে ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা মানেই বেশ কঠিন , নিরস কিছু বুঝি , তারপরে যেখানে পরিচালক স্বয়ং বলেছেন "আমি আপনাকে সস্তা আনন্দ দিতে আসিনি ' । কিন্তু বাস্তবে এটি একেবারেই অমূলক । আসলে ঘটক পরিচালিত সিনেমার প্রতিটা ফ্রেম , আবহ , সংলাপ মানে বলতে গেলে সম্পূর্ণ উপস্থাপনাই অত্যন্ত সূক্ষ্ম বুননে বানানো । যেটা ফাস্টফুডের মত মুখরোচক না হলেও তৃপ্তি দায়ক ।
আচ্ছা যদি বিশ্বাস না হয় তাহলে উদাহরণসহ দেখা যাক । পঞ্চাশের দশকের কলকাতার উদ্বাস্তু কলোনির এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের কাহিনী " মেঘে ঢাকা তারা " । পরিবারটি যে বাংলাদেশ বা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা সেটার কোনো সরাসরি উল্লেখ নেই কোনো সংলাপে কিন্তু মূল চরিত্র নীতার বাবা স্ত্রীর উদ্দেশে বলছেন " খবর তো রাখো না , কাল কমিটি মিটিংএ শুনলাম আবার নাকি উচ্ছেদের হিড়িক বেড়েছে " এভাবেই পরোক্ষ ভাবে বুঝে নেওয়া যায় যে পরিবারটির ওপরে উচ্ছেদের আঘাত আসার সম্ভবনা আছে ।
" মেঘে ঢাকা তারা " তে নীতা চরিত্র নিয়ে প্রত্যেকেই বিশ্লেষণ করেন ঠিকই কিন্তু প্রায় প্রত্যেকের আলোচনা শুরু হয় নীতার প্রেমিক সনৎ এর দেওয়া চিঠিতে নীতাকে মেঘে ঢাকা পড়ে যাওয়া তারার সাথে তুলনা দিয়ে আর শেষ হয় শিলং পাহাড়ের ঢালে দাদার কাছে নীতার বাচঁতে চাওয়ার প্রবল আকুতি দিয়ে -
"দাদা, আমি কিন্তু বাঁচতে চেয়েছিলাম। আমি যে বাঁচতে বড় ভালবাসি। দাদা, আমি বাঁচব। দাদা, আমি বাঁচব।"
কিন্তু বাস্তবে পরিচালক কি আদেও কোনো শেষ টেনেছেন ? আসলেই কি সনতের চিঠিতেই শুধু নীতা মেঘে ঢাকা তারা রূপে দেখা দিয়েছে ? না । অন্তত আমার তো সেটা মনে হয় না । কলকাতা শহরের পিচকালো রাস্তাদিয়ে মানুষের ভিড়ে সাদা শাড়ী পরে কালো মেঘের মতো ছাতা মাথায় ছুটোছুটি করা নীতা কে দেখে কি " মেঘে ঢাকা তারা " ছাড়া আর কোনো উপমা দেওয়া যায় ? যে কালো মেঘের ছাতা তে নিজের মুখ , সুখ , স্বাচ্ছন্দ্য ঢেকে রেখে পরিবারের দায়িত্ব বয়ে চলেছে , আলো ছড়িয়েছে তারার মতো । তারপর সেই তারা আলো হারাতে হারাতে একসময় পরিণত হয়েছে করুণার পাত্রে । এমনকি একসময় যে প্রেমিক নীতাকে মেঘে ঢাকা তারা রূপে চিনেছিল সেও অপেক্ষার পালা বদল করে বিয়ে করে নিল ওর বোন কে । ঠিক তাই নীতার বাবা আক্ষেপের সুরে বলেছেন -
"সেকালে মাইনষে গঙ্গা যাত্রীর গলায় ঝুলাইয়া দিতো মাইয়া, তারা ছিল 'বর্বর'। আর একালে আমরা শিক্ষিত, সিভিলাইজড। তাই লিখাপড়া শিখাইয়া মাইয়ারে নিংড়াইয়া, ডইল্যা, পিষ্যা, মুইছা ফেলি তার ভবিষ্যৎ। ডিফারেন্সটা এই।"
আর হ্যা ভুলে যাচ্ছিলাম প্রায় , যেমনটা বলেছিলাম চলচ্চিত্রে পরিচালক কিন্তু কোনো শেষ টানেন নি অথবা বলা ভালো টানতে পারেননি । কারণ নীতার মতো এই তারারা বাস্তবে কখনো ফুরিয়ে যায় না । তাদের আলোতেই তো বৃদ্ধ পিতা, অভাবের তাড়নায় রূঢ় মা , আত্মকেন্ত্রিক ভাইবোন , উদাসীন দাদা এমনকি নীতিহীন প্রেমিকেরা আলোকিত হয়ে এসেছে যুগযুগ ধরে। তাইতো সিনেমার শুরুতে চলতে চলতে এক নীতার চটি ছিড়ে যাওয়া আর শেষে আরেক নীতার চটি ছেড়ার দৃশ্য দিয়ে এক স্বার্থক বৃত্ত রচনা করেছেন পরিচালক । যে বৃত্তের গোল থেকে দর্শকদেরও মুক্তি নেই , তাদের কে তাইতো বলা - " ভাবুন ভাবা প্রাকটিস করুন " ।
আরও পড়ুন - তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গণদেবতা
0 Comments