তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গণদেবতা





 

উদয়ের পথে শুনি কার বাণী,
‘ ভয় নাই, ওরে ভয় নাই —
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান
ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই । '

কাহিনীর একেবারে শেষের দিক , আর হয়ত গোটা দশেক লাইনের পরেই সমাপ্তি টেনেছেন লেখক তখন ' নজরবন্দি বাবু ' অর্থাৎ যতীন আবৃত্তি করে ওঠে 'পূরবী' থেকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের লেখাটি । আমার কাছে এখানেই শেষ হয় উপন্যাসটি , তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ' গণদেবতা ' । গনদেবতা নামের সাথে পরিচয় সাহিত্যিক অনেক আগেই ঘটিয়ে দিলেও এই স্থানে না আসলে ঠিক সম্পৃক্ত হতে পারেনা গণদেবতার যাত্রা । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধিমে আঁচে পুড়তে থাকা ভারতবর্ষের কোন এক অজ গাঁ শিবকালিপুরের গল্প হল “গণদেবতা” । ময়ূরাক্ষীর তীরে এই গ্রামটিতে অধিকাংশ মানুষ নিম্ন সম্প্রদায়ের বায়েন ও বাউরি আর হাতগোনা কয়েকটা উচ্চ জাতের বাস ।

ভারতের গ্রামীণ জীবন সম্পর্কে Sir Charles Matcalfe বলেছিলেন,

“They seem to last where nothing else last. Dynasty after dynasty tumbles down. Revolution succeeds revolutions! Hindu, Pathan, Moghul, Maratha, Sikh, English are masters in turn, but the village community remains the same.”

অর্থাৎ হাজার হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষের মাটিতে হিন্দু, পাঠান, মুগল, ইংরেজ কত শাসক এলো গেল । কিন্তু গ্রামীণ ভারতবর্ষ হাজার বছর ধরে অকৃত্রিম,অপরিবর্তিত । সেই মহাজনের শাসন, সুদের হিসাবের নামে শোষণ আবার দিনশেষের গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপের চাতালে সবাই সমাবেত হয়ে বাঁচার রসদ হিসেবে আনন্দের অনুসন্ধান । অভিন্ন জীবনেরধারা ।

শিবকালিপুর গ্রামটিও সেই একই । কিন্তু সময় বদলায় সাথে বদলায় রীতিনীতি , সংস্কার । নতুনেরা অভিনবত্বে মাততে চায় , প্রবীণেরা চায় চিরাচরিতকে আঁকড়ে বাঁচতে । শিবকালিপুর গ্রামের একমাত্র কামার অনিরুদ্ধ এবং ছুতোর গিরিশ গ্রামের কাজ ফেলে শহরে গিয়ে দোকান খোলে দুটো নগদ উপার্জনের আশায় এবং ‘এই সামান্য কারনেই গ্রামে একটা বিপর্যয় ঘটে’ যায় । দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বিনিময়ের সংস্কারকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কিছু নগদ উপার্জনের রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে যেন অনিরুদ্ধের মাধ্যমে পরিবর্তনের একটা ঢেউ আসে গ্রামে । যা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পরে নাপিত , বায়েন ইত্যাদি সম্প্রদায়ের মধ্যেও । এই পরিবর্তনের ঢেউ মশাল হয়ে জ্বলে ওঠে গ্রামের পাঠশালার পণ্ডিত দেবু ঘোষের হাত ধরে ।

উপন্যাসটিতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র অনেক, প্রতিটি চরিত্রের মাহাত্ব উপলব্ধি করা যায় নিবিড় ভাবে । আভিধানিক ভাবে “গণদেবতা” –র একটি অর্থ হল গণশক্তির অধিদেবতা অর্থাৎ সরল দৃষ্টিতে এই উপন্যাসের “দেবু ঘোষ” । দীর্ঘদিনের শোষণের সংস্কারের বিরুদ্ধে যে মাথা তুলে দাঁড়ায় , নিজের সর্বস্ব হারিয়েও শেষ সামর্থ্যটুকুকেও ছড়িয়ে দেয় মানুষের মাঝে , সেই “ গণদেবতা” । আবার এক সময় দেবু ঘোষের মনে হয় – ‘ না, কাজ কি এসব পরের ঝঞ্ঝাটে গিয়া ? তাহার মনে পরে ন্যায়রত্নের গল্প । ধর্ম জীবন যাপন করিবার ইচ্ছে হয়’ । এখানেই দেবতা আর গণদেবতার অবস্থান সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে । এখানেই এই লেখাটা শেষ করা যেত কিন্তু সেটা সঠিক সমাপ্তি হয়তো হত না । আর এই উচাটনের কারন উপন্যাসের আরেকটি অবহেলিত হতে থাকা চরিত্র “দুর্গা” । ‘দুর্গা স্বৈরিণী নাকি বিপ্লবী ?’ - প্রশ্নটি পাঠক হৃদয়ে বঁড়শির মত বিঁধে থাকে পুরো উপন্যাস জুড়ে , এমনকি পাঠশেষেও যেটা নির্মূল ভাবে উপড়ে ফেলা যায় না ।

“সে দুরন্ত স্বেচ্ছাচারিণী ; ঊর্ধ্ব বা অধঃলোকের কোন সীমাকেই অতিক্রম করতে তার দ্বিধা নাই । নিশীথের রাত্রে কঙ্কনার জমিদারের প্রমোদভবনে যায় , ... নিজের কলঙ্ক সে গোপন করে না”। গ্রামের সেটেলমেন্ট কাণ্ডে দেবু ঘোষের জেল হলে দুর্গা সেটেলমেন্ট অফিসের পেশকারদের বলে তাকে জামিনের চেষ্টা করে সেখানে সে তার একমাত্র অস্ত্র , শরীরটাকেই কাজে লাগায় কারন পেশকাররা ‘দুর্গা শ্রেনির নারির প্রতি অনুগ্রহ করিয়া থাকে’। এই দুর্গাই নিজের সাপে কামরের নাটক করে পুলিশ কে বিভ্রান্ত করে যাতে প্রজা সমতি করার অপরাধে যতিন , অনিরুদ্ধ আর দেবু ঘোষকে হাজতে যেতে না হয় । আদপে এই উপন্যাসে ‘দুর্গা’ নামক চরিত্রটি কোন ভুবনমোহিনী নারী রুপে ধরা দেয় না, ধরা দেয় অস্বস্তির কারন হিসেবে, যা সমাজের বাস্তব নগ্নতাকে ফুটিয়ে তোলে ।


Post a Comment

0 Comments