হাতের কাগজচোঙা থেকে মুড়ি খেতে খেতে আমার দিকে এগিয়ে আসলো ছেলেটা । একগাল হেসে কুকুরে দাঁত দুটো বার করে বলল- ' বাঙালি ? '
আমি কিছু বলার আগেই হাত বাড়িয়ে দিল করমর্দনের জন্য। একটু হকচকিয়ে গেছিলাম, তাড়াতাড়ি হাতের থেকে ক্যামেরার ফিতেটা খুলে হাত বাড়িয়ে দিলাম ।
“ আমি সাবির। ওপারে থাকি, সিলেট (Sylhet) থেকে খানিকটা ভিতরে । আপনি কোন জেলা ? ’’
ছেলেটা এতগুলো কথা বলে গেল আর আমি হতবুদ্ধি ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আসলে ঘটনাটা একটু আগে থেকেই বলি তাহলে । পুজোর ছুটিতে এসেছি আসাম হয়ে ‘প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড' (Scotland of East) মেঘালয় (Meghalay) ঘুরতে । আর তৃতীয় দিনে আসা ডাউকি লেকে (Dawki Lake) । খাসি পাহাড়ের (Khasi Hill) আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে ব্রিটিশ কালের নির্মিত (১৯৩১) ঝুলন্ত লোহার সেতু পার হয়ে এসে পৌঁছেছি জয়ন্তিয়া পাহাড়ের (Jayantia Hill) এই ডাউকিতে । খাসি ও জয়ন্তিয়া পাহাড়ের মাঝের গিরিপথ বেয়ে ঝর্ণার মতো নেমে এসেছে উমগট নদী (Umngot River)। যেটি ডাউকি নামেও জনপ্রিয় । এখানেই নদী তার খরস্রোত হারিয়ে সমতলে প্রবেশ করেছে । ভারতের সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে নাম পেয়েছে পিয়াইন (Piyain River) ।
শুনেছিলাম, অবশ্য বললে ভালো হবে ছবিতে দেখেছিলাম ডাউকির জল মৎস্যকন্যার চোখের মতো স্বচ্ছ , কিন্তু সে স্বচ্ছতা আমি পেলাম না , তবে যা পেলাম তা বৃদ্ধের ছানিপড়া চোখের মতো ঘোলাও নয় । সদ্য বৃষ্টির জন্যই এই হালকা ঘোলাটে ভাব । বিভিন্ন রঙে রাঙানো কাঠের নৌকা করে কিছুক্ষণ ঘুরলাম ডাউকির জলে। দুপাশে খাড়া পাহাড়ের খাঁজে অনেক স্থানীয় শিশু, কিশোর, যুবক এমনকি বৃদ্ধরা ব্যস্ত মাছ ধরায় । মাছ ধরা আর নৌকা বাওয়া স্থানীয়দের শুধু জীবিকা নয় শখও বটে ।
নৌকা থেকে নেমে জানতে পারলাম এটিও ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত রেখা । এর আগে আমি গেদে-দর্শনার (Gede - Darshana) ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে (Indo-Bangladesh Border) গেছি তাই এখানে কোন কাঁটাতার না দেখে খুবই আশ্চর্য হচ্ছিলাম। আর সেই অবস্থাতেই সাবির নামক ছেলেটির আবির্ভাব । আলাপ পরিচয় শেষে সাবিরই দেখিয়ে দিল যে আমি যথারীতি ভারতের সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে। উঁচু পাথরের উপর দাঁড়িয়ে থাকা একটি সশস্ত্র সীমান্ত প্রহরী আমাকে পিছিয়ে যেতে বলছে । এখানে দুটি দেশের সীমানা নির্ধারণের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে মাত্র কয়েকটি গোলাকার মাঝারি মাপের পাথর। আর তার পাশেই ছোট ছোট পসার খুলে বসেছে কিছু বাংলাদেশি মানুষ, যেখানে তারা বিক্রি করছে কুলের আচার ও মশলা মুড়ি।
এই বিক্রেতাদের দুই প্রান্তে যাতায়াত অবাধ। আর ওরাই দুই দেশের বেড়াতে আসা মানুষদের নিজের সীমানা বুঝিয়ে দেয়। বিডিআর-বিএসএফ (BDR - BSF) এখানে প্রায় দর্শকমাত্র। তারা বিশেষ কোনো ভূমিকা পালন করেন না। সাবির নামের ছেলেটির সাথে আলাপের কারণেই হোক কিংবা হাতে ক্যামেরা থাকার কারণেই একজন কুলের আচার বিক্রেতা বৃদ্ধের সাহায্যে আমি বাংলাদেশের মাটিতে অনেকটাই ভিতরে যেতে পারলাম আর ফ্রেমবন্দি করলাম একটা বিশেষ ছবি যা বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও মেঘালয়কে এক সূত্রে বেঁধে দিল।
ডাউকি লেক থেকে দুই নং জাতীয় সড়ক ধরে কিছুটা গেলেই পাওয়া যায় তামাবিল জিরো পয়েন্ট (Tamabil Zero Point)। এই চেক পয়েন্ট দিয়েই জাফলং (Jaflong) থেকে পন্য আমদানি-রপ্তানি হয় তামাবিল হয়ে বাংলাদেশে। অন্যান্য জিরো পয়েন্টের মতো এখানে যাতায়াতের বিশেষ বিধিনিষেধ নেই। নেই কাঁটাতারের বেড়া। দুই দেশেরই মানুষ জিরো পয়েন্টে ঘুরছে, ছবি তুলছে , পরস্পরের সাথে আলাপ পরিচয় করছে। সীমান্ত প্রহরীরা শুধু সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলেছেন যাতে এই বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে কোনো অনৈতিক চোরাচালান না ঘটে। জাফলং-তামাবিল -র মাঝে রয়েছে একটি অতিকায় প্রবেশদ্বার যাতে লেখা ‘INDIA BANGLADESH FRIENDSHIP GATE' । সত্যিই এখানকার পরিবেশে এই গেট টি সামঞ্জস্যপূর্ণ।
দিনটা দুর্গাপূজার অষ্টমী আর দলে দলে বাংলাদেশ প্রান্তের মানুষ সেজেগুজে ভারতীয় গ্রামের পুজোতে অংশ নিতে আসতে দেখে সত্যি অবাক হলাম। তখনও জানতাম না অবাক হওয়া আরও বাকী কারণ যারা দলে দলে পুজোতে অংশ নিতে আসছেন তাদের কারোরই পাসপোর্ট-ভিসা কিছুই নেই। পুজোর এই কদিন বাংলাদেশী মানুষের অংশগ্রহণ অবাধ করে দেন সীমান্ত প্রহরীরা।
দুটি দেশের সীমানার মাঝের মাটিতে যখন দাঁড়ালাম নিজেকে বড় হালকা লাগতে শুরু করলো । অনেক বিতর্ক থাকলেও আমরা বাঙালিরা মনের গোপনে কোথাও অন্তত বাংলাদেশকে বড় আপন বলে মনে করি ,তবে ভারত-বাংলাদেশ ক্রিকেট বিশ্বকাপের বিষয়টা একটু আলাদা । আর এই গোপন টানটা যা ধরে রাখে সেটা যে “আ'মরি বাংলা ভাষা” তা বলাই বাহুল্য। ...
বিকেল হয়েছিল কিছু আগেই। জাফলং ছেড়ে যখন বেরোলাম সূর্য ডুবে গেছে। পাহাড়ে সন্ধ্যা নামছে, কিন্তু হালকা আলোতে পথঘাট বেশ স্পষ্ট। রাস্তার এক পাশ দিয়ে স্থানীয় একজন কাধে ছিপ আর হাতে মাছের ঝুলি নিয়ে ঘরে ফিরছিল। পিছনে একটা পাহাড়ী কুকুর। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় কানে এলো বেশ দরাজ অথচ সুরেল গলা –
“The Shilong peak will remain unmoved
As long as the sun rises
The ancient tradition will last
While with our eyes to heaven.
Will look at the border lines
Marked out by the gods
We’ll stand at our boundary
To protect the right of heaven.” . . .
6 Comments
খুব ভালো হয়েছে লেখাটা।এগিয়ে চলো।👍
ReplyDeleteধন্যবাদ 😄
Deleteখুব সুন্দর লিখেছিস.. দারুন পরিবেশন
ReplyDeleteধন্যবাদ দাদা😁
DeleteBest of luck 👍
ReplyDeleteThank You . Keep Visiting
Delete