ফাল্গুনের প্রথম সপ্তাহ। সন্ধ্যার পর নদীর দক্ষিণ পাড়ে বয়ছে হিমেল বাতাস । শ্মশান কালীর থানকে ডানে রেখে ইট পাতা রাস্তা চলে গিয়েছে খালের সাঁকোর উপর দিয়ে । এই খালের দুই পাশে দুটো গ্রাম, কৃষ্ণপুর আর রানীনগর। পশ্চিমে সরু খাল, উত্তরে চূর্ণী নদী , আর তার মাঝখানে চৌকোণা জমির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে এক প্রকাণ্ড বটগাছের নিচে ভিড় জমিয়েছে প্রায় শ’দুয়েক পুরুষ, মহিলা, বাচ্চাকাচ্চা। সামনে বাঁশের খুঁটি করে বাঁধা মঞ্চে চলছে যাত্রাপালা । আলখাল্লা পরা সাদা দাড়িওয়ালা এক বৃদ্ধ ফকির দরাজ কণ্ঠে গায়ছে –
“সুন্নত দিলে হয় মুসলমান
নারীলোকের কি হয় বিধান
বামন চিনি পৈতে প্রমাণ
বামনী চিনি কি প্রকারে
সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে ....”
রাতের
অন্ধকারে যেন ফিরে ফিরে আসছে এই গান। ফকির গাইতে গাইতে
মঞ্চ থেকে নেমে এগিয়ে চলেছে দক্ষিণ পূর্বকোণে যেখানে রয়েছে চৌকোনা শানবাঁধানো একটি
বেদি, মামুদ জাফরের সমাধি ।
অনেক ছোটবেলার স্মৃতি এটা। তারপর বহু বছর কেটে গেছে। প্রতিবছরই ফাল্গুন মাসে দোল পূর্ণিমার আগে মেলা বসে ‘জমাদার তলায়’ , ‘হিন্দু-মুসলিম মিলন মেলা’ । কিন্তু সেবারের ‘ফকির লালন’ যাত্রাপালার মতো
স্মৃতিতে থেকে যায় না কোন কিছুই ।
জমাদার মামুদ জাফর ওরফে জমাদার সাহেব নদীয়া
জেলার শিবনিবাস, কৃষ্ণপুর, রানীনগর গ্রামের প্রায় সর্বজন পরিচিত একটি নাম । কৃষ্ণপুর ও রানীনগর গ্রামের সংযোগস্থলে রয়েছে তাঁর সমাধি । শোনা যায় মামুদ
জাফর ছিলেন উত্তর ভারতীয় একজন মুসলমান সিপাহী অথচ সব ধর্ম নির্বিশেষে
গ্রামের সকল মানুষ এই সমাধিতে এসে প্রার্থনা করে
, চাষী গেরোস্থরা তাদের চাষের প্রথম ফসল নিবেদন করে জমাদার সাহেবের সমাধিতে । ফিবছর ফাল্গুন মাসে বসে মেলা, মেলা শুরু হয় শ্মশানকালীর আরাধনার মাধ্যমে। সব ধর্ম নির্বিশেষে
মানুষ জমাদার সাহেবের মাজারে মাটির ঘোড়া দিয়ে মানত করে, প্রসাদ, চাদর চড়ায় । ঐতিহাসিক চরিত্র মামুদ জাফর ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে গেলেও কিছু আনাচে-কানাচে থেকে তার অস্তিত্ব একেবারে মুছে
যায়নি। আর সেই কাহিনী জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে
প্রায় পৌনে তিনশো বছর অতীতে ।
1746 খ্রিস্টাব্দ, দিল্লির সিংহাসনে তখন মোহাম্মদ শাহ । সেই বছরই গিরিয়ার যুদ্ধে বাংলার তৎকালীন
নবাব সারফরাজ খান কে পরাজিত করে বাংলা ও বিহার এর নবাব হলেন পঁয়ষট্টি বছর বয়সী আলীবর্দী খাঁ । কিন্তু উড়িষ্যার নায়েব রুস্তম জঙ্গ ওরফে দ্বিতীয় মুর্শিদকুলি খাঁ আলীবর্দী
খাঁর বশ্যতা স্বীকার করতে সম্মত না হলে বাধ্য হয়ে আলীবর্দী উড়িষ্যা
অভিযান করেন। 1746 খ্রিস্টাব্দে 3রা মার্চ বর্তমান
ভারতের বিহার রাজ্যের ফুলওয়ারী তে আলীবর্দী খাঁ-র কাছে রুস্তম জঙ্গ পরাজিত হন। আলীবর্দী খাঁ হলেন
বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার
নবাব। এই যুদ্ধে নবাব আলীবর্দী খাঁর আফগান বাহিনীতে
ছিলেন মামুদ জাফর । যুদ্ধে বিশেষ বীরত্বের
জন্য নবাবের কাছ থেকে তিনি লাভ করলেন “জগন্নাথ শিরোপা” । সম্ভবত পুরীর জগন্নাথ দেবের
নামানুসারে তাঁর এই শিরোপা । যদিও এটা নিয়ে কিছু মত পার্থক্য রয়েছে । কেউ কেউ মনে
করেন জগন্নাথ নামক কোন এক বিশেষ ব্যাক্তি তাঁকে শিরোপা প্রদান করেন । তবে সুনিতি
কুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন –
“ In the
Raja’s armed forces , a muslim – he might have been bengali , or one from upper
India, Mahmud Jafar by name , was the chief . He had evidently distinguished
himself in the Orissa Compaign of Aliwardi Khan , for it is said by
Bharatchandra that Jagannath Made in Present of a robe of honour to him ,
Cap-a-Pie (sar-o-pa) ; which probably is to be taken to mean that he was
honoured in puri when the Bengali army was before the temple of Jagannath.”
নদীয়ার
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যে “রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের
সভা বর্ণন” অংশে প্রথম মামুদ জাফরের শিরোপা লাভের কথা পাওয়া যায় । ভারতচন্দ্র লিখছেন –
“ শুন শুন নিবেদন সভাজন সব ।
যে রুপে প্রকাশ অন্নপূর্ণা মহোৎসব ।।
সুজাখা নবাবসুত সরফরাজ খাঁ ।
দেওয়ান আলমচন্দ্র রায় রায় রায়া ।।
ছিল আলিবর্দি খাঁ নবাব পাটনায় ।
আসিয়া করিয়া যুদ্ধ বধিলেক তায় ।।
তদবধি আলিবর্দি হইয়া নবাব ।
মহাবদজঙ্গ দিয়া পাতসা খেতাব ।।
কটকে মুরসিদ কুলি খাঁ নবাব ছিল ।
তারে গিয়া আলিবর্দি খেদাইয়া দিল ।।”
আবার ,
“ ঘরিয়াল কার্ত্তিক প্রভৃতি কতজন ।
চেলা খানেজাদ যত কে করে গগন ।।
সিপাহীর জমাদার মামুদ
জাফর ।
জগন্নাথ শিরপা করিলা যার পর।। ”
1741 খ্রিস্টাব্দে ফুলওয়ারীর যুদ্ধের পর কোনো কারণে মামুদ জাফর নবাব আলীবর্দী খাঁর সেনা
ত্যাগ করেন এবং তারই পরবর্তী কোন এক সময়ে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সেনাতে যোগদান করেন
। এরপর মামুদ জাফর বা জাফর খাঁয়ের কোথাও কোনো উল্লেখ পাওয়া
যায় না । সিপাহী জাফর খাঁ হারিয়ে গেলেও, স্থানীয় লোককাহিনীতে তাঁকে পাওয়া যায় মরমীয়
সুফি-সাধক হিসেবে । সম্ভবত মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের
সেনাতে যোগদানের কিছুকাল পরেই জাফর খাঁ অস্ত্র ত্যাগ করে সাধনার পথ বেছে নেন ।
আরও পড়ুন - রেড ভলেন্টিয়ার্স ও স্বাধীনতা সংগ্রাম
1740 খ্রিস্টাব্দের পর পর বর্গী হামলা থেকে
বাঁচতে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র তার রাজধানী কৃষ্ণনগর থেকে শিবনিবাসে স্থানান্তরিত করেন । তখনই তিনি শিবনিবাস
পার্শ্ববর্তী রানীনগর গ্রামে জাফর খাঁ-র থাকার বন্দোবস্ত
করে দেন । শোনা যায় নদীয়া
রাজের দুই মহিষী ও মহারাজা নিজেও জাফর খাঁ কে খুবই ভক্তি করতেন
। এমনকি রাজপরিবারের অনেক সদস্যই নিয়মিত জমাদার সাহেবের
কাছে প্রার্থনা করে আধ্যাত্মিক প্রশান্তি লাভ করতেন বলে জানা যায় । জমাদার সাহেবের আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অনেক কাহিনী আজও স্থানীয়
মানুষের মুখে মুখে ফেরে । এরকমই একটি -
পরিপূর্ণ রাজসভা, হঠাৎ রাজার খেয়াল হলো একজন
অনুপস্থিত , তার প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় জাফর খাঁ । খোঁজ নিতে পাঠানো
হলো রাজ দূতকে । কিন্তু দূত ফিরে
এসে জানালো জাফর খাঁ-র বাসভবনের সমস্ত দরজা
জানালা বন্ধ, অনেক ডেকেও সাড়া
পাওয়া যায় নি । এবার কৃষ্ণচন্দ্র
নিজে চললেন খবর নিতে। জাফর খাঁ -র বাসভবনে পৌঁছে বন্ধ দরজা খুলে রাজা তো অবাক
। পাগলের মত করছেন জাফর খাঁ । ঘরের মধ্যে এক কোন
থেকে অন্য কোনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন । বেশ কিছুক্ষণ এরকম
চলার পরে অবশেষে শান্ত হন এবং মহারাজ কে জানান যে পুরীর রথের ধ্বজা তে আগুন লেগেছিলো
অবশেষে সে আগুন নেভানো গেছে । স্বস্তির নিঃশ্বাস
ছাড়ে জাফর খাঁ
, সাথে কৃষ্ণচন্দ্র । সেবার নাকি সত্যি করেই পুরীর রথে আগুন লেগেছিল আর জাফর খাঁ –র ঘটানো এই অলৌকিক ঘটনা জানতে পেরে পুরীর রাজা তাঁকে অভিবাদন জানিয়েছিলেন ।
এ তো গেল জীবদ্দশায় অলৌকিক ক্ষমতার কাহিনী। জমাদার সাহেবের মৃত্যুর পরেও তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার সাক্ষী হয়েছেন অনেকেই । যদিও তাঁর সঠিক মৃত্যুর সময়কাল জানা যায় না তবে মনে
করা হয় মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মৃত্যুর ( 1782 খ্রিস্টাব্দ ) পূর্বেই তিনি পরলোক গমন করেছিলেন ।
সেসময়
নদীয়াতে ছিল নীল চাষের রমরমা । গ্রামে গ্রামে নীল কুঠি । রানীনগর, বয়সাকুঠি সহ
কয়েকটি গ্রামের মাঠে নীল ক্ষেতে অড়হরের চাষে বিপুল রমরমা । কিন্তু ফি বছর বর্ষার
জলে নদী খালের জল ন্যাতার দেয় চাষের জমিতে । ফলে বেশ ক্ষতির মুখে পরতে হচ্ছিল নীল
কুঠির মালিক হবসন সাহেব কে । জমাদার সাহেব তখন সমাধিস্ত কিন্তু তখনও অটুট তাঁর দৈব
প্রতিপত্তি । হবসন সাহেব যদিও এসবে বিশ্বাস রাখতেন না কিন্তু বারবার ক্ষতির মুখে
পরে একরকম বাধ্য হয়েই তিনি মানত করেন - যদি পরের বছর ফসলের ক্ষতি না হয় তবে ছোট্ট
সমাধি ফলকের উপর সমাধি সৌধ গড়ে দেবেন । বাস্তবিকেই সেবার ফসলের ক্ষতি হয়নি , হবসন
সাহেব বিস্মিত হন এবং কথামত সমাধি সৌধ বানিয়ে দেন যেটা আজও রয়ে গেছে । তবে সেখানে
কোন ফলকে হবসন সাহেবের নাম বা পরিচয় পাওয়া যায় না । থাকার মধ্যে আছে শুধু মানুষের
মুখে মুখে চলে আসা জমাদার সাহেবের অলৌকিক কৃপা আর ধর্ম নিরপেক্ষ ভক্তির নিদর্শন ।
তথ্যসূত্রঃ
1. জমাদার সাহেব মামুদ জাফর – শ্রী হারাধন দত্ত
2. রায় গুণাকর ভারতচন্দ্রের গ্রন্থাবলি – দে ব্রাদার্স
3. মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ – অলোক কুমার চক্রবর্তী
4. Dr. SunitiKumar Chatterjee : The Court Of Raja Krishnachandra of Krishnagar etc.
4 Comments
বেশ ভালো লাগলো এবং যথেষ্ঠ গোছানো লেখা।
ReplyDelete🥰🥰🥰 সফল আমার প্রচেষ্টা
Deleteদাদা আমাকে একদিন ওখানে নিয়ে চলুন ঘুরতে।
ReplyDeleteচলে আসুন আমার বাড়িতে
Delete