ধরা যাক দিনের শেষে কোন এক পুরুষকে ( সিংহ কি বিড়াল সেটা বাহুল্য নয়) বাড়ি ফিরে এক ঢোক জল গলধঃকরণ করার আগেই যদি প্রিয়তমা স্ত্রী জিজ্ঞেস করে বসে - ' আচ্ছা তোমার কাছে কে বেশি প্রিয় ? আমি না তোমার মা ?' মুখের মধ্যেই তেতো হয়ে যাওয়া জলের ঢোক গিলতে গিলতে পুরুষটি যখন বুঝতে পারে পাশের ঘরের পর্দার পিছনে তার মা অপেক্ষারত ছেলের উত্তরের জন্য, পুরুষ তখন সিংহ হোক বা বিড়াল উত্তরের পরিবর্তে তার মনে পাল্টা একটি প্রশ্নের উদয় হয় - 'এই প্রশ্নের কি সত্যিই প্রয়োজন ছিল ? '
ঠিক একই প্রশ্ন আসে আমার মনে যখন কেউ জিজ্ঞেস করে- 'কোনটা বেশি প্রিয় পাহাড় নাকি সমুদ্র ? '
এবার হয়তো কেউ বলবেন- 'আচ্ছা ডেপো তো এই ছোকরা ! ভ্রমণের সাথে সংসারের উপমা ?' সেক্ষেত্রে বলব উপমা কতটা ঠিক বা কতটা ভুল তা ভ্রমণপ্রিয় বিবাহিত ব্যক্তিরাই বিচার করুন । আমি আর বিস্তারিত না গিয়ে আমার ভ্রমণ-কাহিনী তে প্রবেশ করি।
ঘটনাটা এক মে মাসের , ভ্যাপসা গরমে হাঁপিয়ে উঠেছিল সবাই। আর আমি হাঁপিয়ে উঠেছিলাম দীর্ঘদিন অজানার উদ্দেশ্যে না বেড়িয়ে।পাহাড়-জঙ্গল নাকি সমুদ্র কার ডাকে সাড়া দেব সেই অনিশ্চয়তার মধ্যেই আমাদের ভ্রমণ নিউটনের প্রস্তাব পেশ হল। গড়ের মাঠ পকেটের সাথে পাল্লা দিয়েই চললাম উড়িষ্যার চাঁদিপুর। সমুদ্র, নদী-মোহনা, পাহাড়-জঙ্গল সব রকমের চাহিদা পূরণকারী কামধেনু হল চাঁদিপুর ভ্রমণ।
জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ, বাতাসে তাপমাত্রার কোনো ঘাটতি নেই। জনশতাব্দী এক্সপ্রেস তখন ছুটে চলেছে বালেশ্বরের দিকে। আমরা যথারীতি চিরাচরিত স্বভাবেই নাচানাচি শুরু করেছি। প্রায় গোটা ট্রেনের কামরার দৃষ্টি আমাদের দিকে। হয়তো ভাবছে এরা কোথাকার নমুনা ? যদিও সেই ভাবনা আমাদের আচরণে কোনো প্রভাব ফেলে না কোনদিন। অনেকক্ষণ দাপাদাপি করে একটু ক্লান্ত হয়ে যখন স্থির হলাম। সুযোগ পেয়ে পাশের সিটের ভদ্রলোক বললেন- 'চাঁদিপুর কি ঘুরতে ?'
আমি হ্যাঁ বলে মাথা নাড়তেই বললেন - 'কি পাবে! তেমন কিছুই তো নেই দেখার, একদিনের পিকনিক টিকনিক ঠিক আছে । '
কথাগুলো শুনে মনের সব উন্মাদনা নিমেষেই হাওয়ার হয়ে গেলেও, মুখে হার মানলাম না, বললাম - 'আমরা অ্যাডভেঞ্চার খুজে নিই ।' তবু আমার কথায় হয়তো দৃঢ়তা কিছুটা কম ছিল, আর সেটা ধরতে পেরেই সামনের জানালার পাশে বসা আরেক ভদ্রলোক আমার দিকে তাকালেন আর সরে গিয়ে পাশে বসতে ইশারা করলেন । পাশে বসতেই শান্ত ও ধীর ভাবে বললেন - 'ওসব কথা নিয়ে ভেবনা। যাও ভালোই লাগবে, আমি প্রতিবছর দেশে ফিরে কিছু দিন অবশ্যই ওখানে কাটাই ।'
ট্রেন থেকে নেমে চাঁদিপুর সৈকতে পৌঁছলাম তখন সওয়া চারটের একটু বেশি । সমুদ্রে তখন জোয়ার চলছে। সমুদ্র সৈকত জুড়ে অনেক মানুষের সমাগম । চাঁদিপুর কে ঠিক সমুদ্র বলতে অনেকেই নাক সিটকান । তার কারণ সমুদ্রের মতো এখানে না আছে বিশাল ঢেউ না আছে গভীরতা । সমুদ্রের ভেতর মাইল খানেক পায়ে হেঁটে চলে যাওয়া যায় অনায়াসেই। জল কোমরের ওঠে না। হাঁটতে হাঁটতে সত্যিই অনেকটা চলে গেছিলাম আমরা, তারপর যখন মনে হলো পায়ের নিচে জল নেমে গেছে তখন পিছনে ফিরে আবার হাটা। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে তখন । জল সরে যেতেই বালি নিচের কাঁকড়া বেরিয়ে পরেছে। অন্ধকারেও ওদের দৌড়োদৌড়ি টের পাচ্ছিলাম।
পরদিন খুব ভোরেই উঠে পড়লাম। তখনও অন্ধকার । আসলে নতুন কোন জায়গায় গিয়ে যদি ভোর আর সন্ধ্যার সাক্ষী না থাকলেন তাহলে সে ভ্রমণ অপূর্ণ থেকে গেল। আমি অন্তত এটাই বিশ্বাস করি।
সেই ভোরের মায়াবী আলো আঁধারিতে চাঁদিপুরের বালির সমুদ্রসৈকতে যে মায়ার খেলা আমি অনুভব করেছিলাম তা বর্ণনা করার ক্ষমতা আমার নেই। সময়টা মনে পড়লে মনের মধ্যে এক অদ্ভুত সুরের রাগ বেজে ওঠে যা আগে কখনো কোথাও শুনিনি।
তখনো সূর্যোদয়ের বেশ দেরি তাই আমরা সূর্যিমামা কে এগিয়ে আনতে তার দিকে চলা শুরু করলাম। বালিরচর ধরে সোজা উত্তর-পূর্বে হেঁটে গেলে পৌঁছে যাওয়া যায় বাঘাযতীন খ্যাত সেই বুড়িবালাম নদীর মোহনায় । প্রায় পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছনো গেল সেই নদীর মোহনাতে যার স্থানীয় নাম বুধাবালাঙ্গা ।
বিস্তীর্ণ নদীর চর আর সমুদ্র সৈকত মিলেমিশে বিশাল এক প্রান্তরে ঝাউবনের সাক্ষী রেখে আমরা কয়েকটি প্রাণী এগিয়ে চলেছিলাম , সাথে একটি চার পে প্রাণীও ছিল। অচেনা অজানা প্রান্তরে লেজ নাড়তে নাড়তে বন্ধুর মতো পিছু নিয়েছিল সেই কাকভোর থেকেই।
বুড়িবালামের যে পাড়ে আমরা ছিলাম সেটি জনমানবহীন। সার দিয়ে মাছ ধরার ছোট বড় ট্রলার নোঙ্গর করা। অন্য পাড়ে দু-একটা ছোট ডিঙি নৌকা দেখা যাচ্ছিল।পায়ের নিচে রংবেরঙের বিভিন্ন শামুক-ঝিনুকের মাঝে এক অদ্ভুত সুন্দর পাতাবাহার কাছে ভরা জায়গাটা জোয়ারের জল ধীরে ধীরে তলিয়ে নিচ্ছিল সমুদ্রের তলায় । মাথার উপর থেকেই ডেকে যাচ্ছিল সীগালের দল।
সময়টা মাছেদের প্রজনন ঋতু শুরুর দিক , তাই বাণিজ্যিক মাছ ধরা নিষিদ্ধ। ট্রলার মেরামতের কাজ করা দু তিনজন ছাড়া আরো একজনকে দেখলাম জাল ফেলে মাছ ধরতে । তার সাথে কিছুক্ষণ আলাপ জমিয়ে যখন আমরা ফেরার পথ ধরলাম তখন সূর্য সপ্রভ ভঙ্গিমাতে অবতীর্ণ হয়েছে।
ঘরে ফেরার ট্রেন আগে থেকেই ঠিক ছিল । হাতে তাই গোটা একটা দিন । পরদিন সকলেই রওনা দিলাম কুলডিহার জঙ্গলের উদ্দেশ্যে । পথে নীলগিরি পাহাড় আর পঞ্চলিঙ্গেস্বর মন্দির ঘুরে ফরেস্ট পারমিট অফিস পৌঁছতেই সেকি তুমুল বৃষ্টি । জঙ্গল সাফারির অনুমতি পত্র নিয়ে রওনা দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি থেমে গেলো ঠিকই , তবে মেঘ পিছু ছাড়লো না । কুলডিহার পাহাড়ী জঙ্গলের মাথায় আরও ঘন হতে লাগলো।
কুলডিহার জঙ্গলে বিশেষ প্রাণী বলতে প্রকাণ্ড হাতির দল ও হরিণ। কিন্তু এদের কারোরই দেখা পাইনি কপাল দোষে। পরিবর্তে আমাদের আতিথেয়তা করেছিল শত শত জোকের দল । বৃষ্টিভেজা ঘন জঙ্গলে নানা পশু পাখির ডাক ঝরনার কুলকুল শব্দ মিলেমিশে আলাদা এক পরিবেশ। কথায় বলে এক যাত্রায় পৃথক ফল , আমরা পেলাম এক যাত্রায় অনেক প্রকার ফল। তাহলে কি মনে হয় ? জঙ্গল , পাহাড় নাকি সমুদ্র অথবা যদি সব পাওয়া যায় একসাথে !
1 Comments
Valo lagche.Carry on👍🏼
ReplyDelete