সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই বিট্টুর মনে হল ঘরটাতে একটু বেশি আলো ঢুকে পড়েছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই অবাক। এই ভরা চৈত্র মাসে বাইরেটা কুয়াশাতে ছেয়ে গেছে । হালকা ঠান্ডা হাওয়া বারান্দাতে বার বার পাক খেয়ে ঘরে ঢুকে আসছে । কি আজব কান্ড হয় আজকাল । সত্যিই অবাক লাগে। রচনা তে পড়া গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত সব যেন ঘেঁটে ঘ। যেন কবাডি খেলার সময় একে অপরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। গতকাল সন্ধ্যার দিকে হঠাতই চারিদিক গুমধরিয়ে ঝড় উঠলো , চারিদিকে শুকনো পাতা, ধুলো সব একাকার করে হঠাৎ থেমে গেল । এটাই কি তবে এখনকার কালবৈশাখী ?
বিট্টু ঘড়িতে দেখল এখনও ছটা বাজে নি জানলা দিয়ে উঁকি দিলো, সদর দরজা আটকানো, তারমানে মা এখনো ঘুমোচ্ছে । হঠাৎই মনটা একরাশ খুশিতে নেচে উঠলো। আজ কতদিন হল বাড়ি থেকে বেরোতেই পারে না । রাখাল কাকা বলছিল সারা পৃথিবীতে নাকি কি আউশা এসেছে । স্কুল টিউশনি সবেতেই ছুটি ঘোষণা হয়ে গেল। ছুটি ঘোষণার দিন অবশ্য শ্যামল স্যার বলেছিল সারা পৃথিবী জুড়ে এক বিশেষ ভাইরাস ছড়াচ্ছে , করোনাভাইরাস । ভাইরাস কি তা বিট্টু জানে। বিজ্ঞান পড়তে তার ভালোই লাগে। রাখাল কাকাকে অবশ্য বোঝাতে পারেনি বিট্টু, সে আউশা ভেবেই খুশি, ভাইরাস কি তা নিয়ে তার কোন মাথাব্যথা নেই। এবার বিট্টু চুপিচুপি খাটের তলা থেকে কটা বিস্কুট নিয়ে সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেল। রাস্তার নেড়ি টাকে তো খেতেই দেয় না কতদিন। ওর আবার দুটো ছোট ছোট বাচ্চা ও হয়েছিল। কি জানি ওরা কেমন আছে! কি খাচ্ছে! মা বলেছে কথা না শুনে বাইরে বেরোলে নাপিত কাকাকে ডেকে মাথা ন্যাড়া করে দেবে । আঁতকে উঠেছিল সে, করোনার থেকেও নাপিত কাকাকে ভয় বেশি তার । মাথা ন্যাড়া করে দিলে স্কুল খোলার আগে যদি চুল ঠিকঠাক না ওঠে ! তাহলে সে ফুলির সামনে যাবে কি করে? ফুলি বিট্টুর বান্ধবী। ফুলির কথা মনে হতেই বিট্টুর গাল দুটো কেমন রাঙা হয়ে উঠলো । হঠাৎ রাস্তায় একটা আওয়াজ হলো। বিট্টু দেখল আর দেরী করা ঠিক হবে না। অতি সন্তর্পনে সদর দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ল। বাইরের রাস্তা পুরো ফাঁকা , জনমানবহীন। শুধু প্রাচিরের পাশে নেড়িটা তার বাচ্চা দুটোকে নিয়ে গুটি মেরে শুয়ে ছিল। বিট্টু কে দেখে লেজ নাড়তে লাগলো। হাতের বিস্কুট গুলো ওদেরকে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল বিট্টু। বিস্কুট গুলো প্রায় খাওয়া শেষ হঠাৎ এই খাওয়া থামিয়ে উল্টোদিকের গলিতে ঢুকে গেল ওরা। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ওরা আর এলো না দেখে, বিট্টু বাড়ি ঢুকতে যাবে এমন সময় চোখে পড়ল কুয়াশা ঠেলে কেউ একজন আসছে। কাছে আসতেই দেখল হারান জ্যাঠা।
- ‘ও জ্যাঠা, এত সকালে কোত্থেকে আসছ ? বাইরে থেকে আসলে কিন্তু তোমাকে কোয়ারেন্টাইন এ থাকতে হবে।’
শেষের দিকটা বেশ বিজ্ঞের মতো টেনে টেনে বললো বিট্টু। হারান জ্যাঠা বিট্টু দের সামনের বাড়িতেই থাকে। অনেক সময় অনেক মজার গল্প শোনায় । ওনাকে কখনো রাগতে দেখেনি সে। সব সময় মুখে হাসি। এবারেও সেই হাসিটা হেসেই বললো - 'আচ্ছা তাই নাকি রে ? তা বল দেখি কোয়ারেন্টাইন কি জিনিস? কোথা থেকে এলো ?'
এবার বিট্টু পড়লো মহাফাঁপরে । টিভিতে রাতদিন শুনে শুনেই যেটুকু জেনেছে, এতকিছু জানবে কোত্থেকে। শেষে যা জানে তাই বলবে ঠিক করলো। আমতা আমতা করে বলল – 'ওই যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচতে বাইরে থেকে এলে পনেরো দিন ঘরে বন্দী থাকা ।'
‘হমম’ , বলে মাথা নাড়লো হারান জ্যাঠা। তোকে তো আর গল্প শোনানো হবে না । কিন্তু এর যে একটা ছোট্ট গল্প আছে শুনবি নাকি ?
বিট্টু বলল, 'কেন হবে না ?’
- 'সে বাদ দে, শোন তবে' ... বলে শুরু করলো -
'চৌদ্দ শতকের গোড়ার দিকে মানে ধর 1370 সালের কথা বলছি , ইউরোপ মহাদেশের দেখা দিয়েছিল এক ভয়ঙ্কর মহামারির। প্রায় কুড়ি মিলিয়ন মানুষ মারা যায় সে সময়। এখন যেমন এই মহামারির কারণ করোনাভাইরাস তখন ছিল প্লেগ। কোন প্রাণী থেকে প্লেগ ছড়ায় জানিস তো ? '
- ' হ্যাঁ, ইঁদুর । আমিতো গল্পে পড়েছিলাম আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনীও নাকি প্লেগ এর কবলে পড়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল।'
'বাবা তুই এটাও জানিস। তা যাই হোক , তখন চারিদিকে একটা কথা রটে গিয়েছিল যে প্লেগের জীবাণু ছড়াচ্ছে জাহাজের মাধ্যমে । তাই ভেনিস শহরের বাণিজ্য বন্দরে আসা কোন জাহাজকেই শহরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়েছিল না। জাহাজের নাবিক ও কর্মচারীদের কে পাঠানো হয়েছিল পার্শ্ববর্তী একটি দ্বীপে তৈরি করা হাসপাতালে । সেখানে 40 দিন রাখা হয়েছিল তাদেরকে । ইতালীয় শব্দ ‘কোয়ান্টনারিও' মানে হলো 40 , তাই একে বলা হতো কোয়ারেন্টাইন সেন্টার। পরবর্তীতে বিভিন্ন মহামারীর সময়ে এই নির্বাসনের দিন সংখ্যা কম বেশি হলেও এই কোয়ারেন্টাইন শব্দটিই ব্যবহার করা হতে থাকে, যা আজও ব্যবহার করা হচ্ছে। বুঝলি ?
হ্যাঁএএএএএ .... লম্বা সুর টানলো বিট্টু ।
অমনি মা ডেকে উঠল বাড়ির ভেতর থেকে। আর কোথায় যাবে সে। এক ছুটে বাড়ি ঢুকে পরতেই দেখল মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ।
- 'বাইরে কি করছিলি ?'
- 'না মানে ওই হারান জ্যাঠা ....'
- 'হ্যাঁ জানি। কাল শুনলাম উনারও করোনা হয়েছিল, গত পরশু নাকি মারা গেছেন । তোকে বলিনি ভয় পাবি বলে। যা এবার হাত মুখ ধুয়ে ঘরে ঢোক।'
বিট্টুর পা যেন মাটিতে আটকে গেল। মা এসব কি বলছে ! ওটা কে ছিল তাহলে ?
4 Comments
অসাধারণ।। শেষের দিকটা আপাত মজার সাথে প্রথাগত কুসংস্কার ও অন্ধ অনুকরণ কে দীপ্ত করেছে যা সচরাচর দেখা যায় আমার দেশের অলিতে গলিতে।। আরো লেখো।। আশীর্বাদ রইল।।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ দাদা । তোমাদের আশীর্বাদ থাকলেই হবে ❤
Deleteখুব ভালো।
ReplyDeleteপুরোটা চিত্রনাট্যের মতো।একটা শর্টফিল্ম হতে পারে।👍
Thank you . It means a lot. পরিচয় টা বুঝলাম না যদিও
Delete