নিউটনের পাহাড় সিং [ Newton & King Of Mountain ]



শ্যামপুর (Shyampur) ছেড়ে গাড়ি ছুটে চলেছে রাঁচি-পুরুলিয়া (Ranchi - Purulia) হাইরোড ধরে । ডিসেম্বরের পড়ন্ত বিকেল । অন্যবারের মতো বছর শেষে বাংলার শীত তার অস্তিত্বের কিছু কার্পণ্য করতে চাইছে না । টুপি দিয়ে আরাম করে বসলাম গাড়ির জানালাতে মাথা হেলিয়ে । রাস্তার দু'পাশে রাঙ্গামাটির বিস্তৃত মাঠ , দূরে কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্ন দু-একটা টিলা-পাহাড় দেখা যাচ্ছে । এই দৃশ্যটা গত চার দিনে একই হয়ে গেছে । তাই জানলা দিয়ে আসা ঠাণ্ডা হাওয়ার শুকনো আরামে চোখ বুজে ফেললাম । ধীরে ধীরে ভেসে আসতে থাকলো গত চার দিনের ঘটে যাওয়া সব কিছু । ঘন্টাখানেক আগে দেউলঘাটা থেকে গাড়িতে করে রওনা দিয়েছি পুরুলিয়া স্টেশনের উদ্দেশ্য। সুপ্রাচীন গুপ্তযুগের ভগ্নপ্রায় দুটো মন্দির দেখে পাশ দিয়ে বয়ে চলা কাঁসাই নদীর চরে কাটিয়েছি পড়ন্ত বিকেলের অনেকটা সময় । শীতের বিকেলের পড়ন্ত রোদ আর পাথর নুড়ির মধ্যে বয়ে চলা কাসাই নদীর  কুলুকুলু শব্দ , সব মিলিয়ে ভ্রমণ এর উপসংহার টা বেশ শীতের পিঠা খাওয়ার মতই আমেজে কেটেছে । তিন দিন আগে যখন সকাল-সকাল ট্রেন থেকে নেমে ছিলাম তখন মনের উত্তেজনা ছিল তুঙ্গে । জীবনের প্রথম ভ্রমণ তাও আবার পাহাড়ে । না হোক সে হিমালয় , অযোধ্যা পাহাড় দিয়ে শুরু হোক না মন্দ কি ! পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সাপের মত প্যাঁচানো রাস্তা ধরে বাস পৌঁছলো অযোধ্যা হিলটপের বাসস্ট্যান্ডে।  সেখান থেকে অনেক খুজে স্থানীয় বাজার গ্রামের শেষ প্রান্তে জঙ্গলের মধ্যে এক ছোট্ট ঘরে আশ্রয় নিলাম ।... হঠাৎই গাড়িটা দুলে উঠে থেমে গেল । আমার সুমধুর ফ্ল্যাশব্যাকের জালটাও ছিঁড়ে গেল নিমিষেই । ছোট্টু দা, আমাদের এই কদিনের ভ্রমণের বাহন চালক গাড়ি থামিয়েছে এক পেট্রোল পাম্পে । সন্ধ্যা নেমেছে । আড়মোড়া ভেঙে গাড়ি থেকে নেমে দেখি আমাদের নিউটন বাবু যথারীতি চায়ের দোকান খুঁজে চা পানের প্রস্তুতি নিচ্ছে । আর হ্যাঁ , এখানে বলে রাখি এই নিউটন (Newton) কিন্তু স্যার আইজ্যাক নিউটন না । ইনি আমাদের ভ্রমণ নিউটন । এই নামের পেছনেও এক মজার কাহিনী । সংক্ষেপে বললে এরকম যে বিজ্ঞানী নিউটনের যেমন বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে অনেক অবদান ঠিক তেমনি আমাদের ভ্রমণ স্থান আবিষ্কারে আমাদের নিউটনের অবদান কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ । চা পানের বিরতির পর গৌরিনাথ ধামের ( Gourinath Dham) পেট্রোল পাম্পে থেকে আবার রওনা দিলাম স্টেশনের উদ্দেশ্যে । কিছুক্ষণ জানলা দিয়ে বাইরে দেখতে দেখতে একসময় বাজার বাড়িঘর বেরিয়ে শুরু হলো গাঢ় অন্ধকার । তাই আবার চোখ বুঝলাম । মনে পড়লো পুরুলিয়া আসার দ্বিতীয় দিনের একটা ঘটনা । আগের দিন সন্ধ্যায় পাশের ময়ূর পাহাড়ে উঠে অযোধ্যা পাহাড়ের গ্রামগুলোর একটা বার্ড ভিউ চোখে ভরে নিয়ে এসেছি । আর আজ  সকাল-সকাল স্নান করে বেরোবো মার্বেল লেক (Marble Lake), বামনী ফলস (Bamni Falls) , আপার ড্যাম (Upper Dam) ঘুরতে । ভোরে উঠে নিউটন বাবুই খোঁজ নিয়ে এলেন কাছেই কোথাও জঙ্গলের ভিতরে পাথর বাঁধানো এক পুকুর আছে । তাই আমাদের স্নান আজ থেকে সেখানেই হবে । নিউটনের আবিষ্কার তাই আমরা নির্দ্বিধায় সবাই চললাম সেই পুকুরের দিকে । জঙ্গলের হাঁটাপথ শেষ করেও ঝোপঝাড়ের পাশ দিয়ে বেশ খানিকটা চলে গিয়ে সত্যিই পেলাম পুকুরটা । একেতো শীতকালের সকাল , তার ওপরে পাহাড়ি পুকুরের হিম ঠান্ডা জল , কাঁপতে কাঁপতে স্নান সেরে উঠছি এমন সময় চোখে পড়লো পুকুরের এক কোনের একটা মহুয়া গাছের নিচে একজন এসে দাঁড়িয়েছে । সবাই যথারীতি অবাক , চমকে গেছি । একেই জঙ্গলের মধ্যে তার উপর আবার এই ঠান্ডায় খালি গা , পরনে একটা গেরুয়া কাপড় , মাথায় ছেঁড়া চাদর প্যাঁচানো , বড় বড় গোঁফ দাড়ি । আমাদের দিকে বেশ কৌতুহলী চোখ করে তাকিয়ে আছে । আমরা ওনাকে দেখতে পেয়েছি দেখে একটু এগিয়ে আসলেন আমাদের দিকে । যথারীতি আমাদের দিক থেকে এগিয়ে গেল আমাদের নিউটন । আমরা জল থেকে উঠতেই ফিরে এলো নিউটন আর আমাদের ঘরে ফেরার তাড়া দিতে দিতে এগিয়ে চলল।  পিছন ফিরে দেখলাম গাছের পিছনে জঙ্গলে হারিয়ে গেল লোকটা । অনেক তোষামোদ করেও লোকটার সম্পর্কে কিছুই বলতে রাজি হলেন না নিউটন । শুধু বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলল -  ‘কাল সকালে আমরা যাব পাহাড় সিং-এর জঙ্গলে । ‘ পরদিন সকালে পৌছালাম সেই পুকুরের পাড়ে । নিউটন ই পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল সেই মহুয়া গাছের পিছনের জঙ্গলে । ভাবতেই পারিনি গাছগুলো আড়ালে একটা ছোট্ট সরু রাস্তা চলে গিয়েছে । যার শেষে রয়েছে একটা মাটির ঘর । হঠাৎ করেই পাশের ঝোপ থেকে খসখস শব্দ করে মুখে একগাল হাসি নিয়ে বেরিয়ে এল কালকের সেই লোকটা । কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম আমরা সবাই । লোকটার নাম পাহাড় সিং এখানেই তার বাস আমাদের নিউটন বাবু তার আমন্ত্রণই কালকে নিয়ে রেখেছিলেন। পাহাড় সিং ! তার নাম সার্থক বটে । জঙ্গলের একটা অংশে তার ঘর ও পুকুর । আশেপাশের বেশ কিছুটা অংশে তার নিজস্ব মেহনতে গড়ে তোলা বিভিন্ন রকম ঔষধি গাছ ও অনেক প্রকার সবজির গাছ । যা দেখে এটাই মনে হল পাহাড়ের এক কোনে সে তার নিজের পৃথিবী গড়ে নিয়েছে । 

বড়জোর প্রাইমারীর গন্ডি পেরোনো এই মানুষটির সাথে কথা বললে বোঝা যায় এই জঙ্গলের প্রতি , জঙ্গলের প্রাণী গাছপালার প্রতি তার ভালোবাসা কতটা । বাড়ির একটা কোনা ভাঙ্গা দেখে জিজ্ঞেস করাতে জানতে পারি এটা হাতি ঠাকুরের আক্রমনের ফল । হাতিকে ওরা হাতি ঠাকুর বলে । হাতি কে আক্রমণ না করে নিজেদের বাঁচার জন্য গাছের উপর বানিয়েছে একটা ঘর । ওখানেই রাত্রে সকলে মিলে উঠে যায় আর মশাল জ্বালিয়ে পাহারা দেয় নিজের পৃথিবী । আমাদের নিউটনের সাথে আমিও উঠে পড়েছিলাম সেই ট্রি কটেজে । উঠে যা দেখলাম তা পাহাড় সিংয়ের মুকুটে একটা পালক জুড়ে দিল । গাছের উপরে ঘরে পাখিদের থাকার ব্যবস্থা করেছে সে এবং সেই বাসাতে দুটো ঘুঘু পাখির বাচ্চা ও লক্ষ্য করলাম যাদের নাকি পাশের জঙ্গলে মাটি থেকে পেয়েছিল এই পুরুলিয়ার সেলিম আলী । 

সেদিন সকালটা পুরোটাই আমরা পাহাড় সিং ও তার পরিবারের সাথেই ছিলাম । তবে ফেরার আগে সে তার নিজের হাতে চাষ করা রাঙা আলু না খাইয়ে ছাড়েনি আমাদের । এখানেই শেষ নয় । পরদিন পাহাড় সিং আমাদের নিয়ে যায় তার তালুর মতো চেনা জঙ্গল দেখাতে । শাল পলাশের বন এর মধ্যে দিয়ে ছোট বড় পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সে আমাদের নিয়ে পৌছে এক প্রস্রবণে । ছোট্ট একটা কুয়োর মতো জায়গা থেকে  ঈষদ উষ্ণ  জল বেরিয়ে ঝরনার মতো বয়ে চলেছে । জলধারা টির নাম সীতাকুন্ড (sita kund) । “রামচন্দ্রের সাথে চৌদ্দ বছরের বনবাস জীবনের কোন এক সময় মা সীতা এই কুন্ডের জল পান করে তৃপ্তি লাভ করেছিলেন”- বলল পাহাড় সিং । আরো জানলাম মহাপীঠ হিংলাজ (Hinglaj) যেখানে সতীর ব্রহ্মরন্ধ্র পড়েছিল সেই মহাপীঠ দর্শন এর আগে এই সীতাকুন্ড দর্শন না করলে নাকি পূর্ণার্থী পুণ্য অপূর্ণ থেকে যায় । হিংলাজ দর্শনের কাহিনীতো অবধূত এর বইতে পড়েইছিলাম । তাই বলা যায় না কোন দিন হয়তো হিংলাজের উদ্দেশ্যে রওনা হতে হবে তাই সীতাকুণ্ডে স্নান করতে নেমে পড়লাম । স্নান সেরে পাহাড় সিং এর কাছে গল্প শুনতে শুনতে ফিরে এলাম আমরা । সে আমাদের বলল আরও ত্রিশ বছর আগের জঙ্গলের গল্প । জঙ্গলের পরিবেশ বাঁচানোর জন্য তার একার প্রচেষ্টার গল্প । নিজে হাতে লিফলেট লিখে বিলি করার গল্প । শুনতে শুনতে এসে পড়ি সেই পুকুরপাড়ে যেখান থেকে নিউটন আবিষ্কার করেছিল পাহাড় সিং কে । পুকুরের পাড়ে একটা গাছ তলায় বসে পাহাড় সিং তার বাঁশিতে সুর তোলে । পাহাড়িয়া এক সুর । অচেনা সেই সুর যেন বারবার দূরের পাহাড় থেকে ফিরে ফিরে আসে আর আমি ........
ঝাঁকুনি খেয়ে আবার ঘোরটা ভেঙে যায় । বুঝলাম স্টেশন এসে গেছে । এবার পাহাড়ি হওয়াকে বিদায় দিয়ে ঘরে ফেরার পালা । আবার শুরু হবে নিত্য জীবন । পুরুলিয়ার পাহাড় থেকে যাবে স্মৃতির মনিকোঠায় । শুধু একটা প্রশ্নের সমাধান হবে কিনা জানিনা ! নিউটনের আবিষ্কার নিয়ে তো কোন সন্দেহ থাকে না । কিন্তু কোনটা নিউটনের সেরা আবিষ্কার ? পুরুলিয়ার পাহাড় নাকি পুরুলিয়ার পাহাড় সিং ?


Post a Comment

0 Comments