বর্ষা নেমে পরেছে কোমর বেঁধে । হাঁসফাঁস করে ওঠা চূর্ণী নদীটা একটু একটু করে যেনো ফিরে পাচ্ছে প্রাণ। বারোয়ারি পুজো মণ্ডপের পিছন দিকের নদী ঘাট টা বাঁধানো হয়েছে এবছর । নদীর জল এসে ছুয়েছে বাঁধানো সিড়ির চাতাল ।
সারাদিন হুরুম হুরম করে মেঘ ডেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বৃষ্টির জল । সকাল থেকে সংসারের সব কাজ সেরে দুপুরের খাওয়ার পর বসে আমাদের বাড়িতে লুডোর আসর । মা , সেজমা , কাকিমা সব মিলে লড়াই লাগায় হাতে বানানো লুডো ছক্কা নিয়ে । আর সেই আসরের মধ্যমণি আমার ভাইজি । মাঝে মাঝে অথিতি ছোট বোন আর আমি খুব আগ্রহী দর্শক । তবে দর্শক হলেই চলবে এমন না । মাঝে মাঝে আমিও নেমে পড়ি লুডুর ময়দানে ।এরকম লুডুর লড়াই অনেক দিন দেখিনি আমাদের বাড়িতে । অনেক ছোট বেলাতে এরকম হতে দেখেছি আবছা মনে পরে। তখন একটা সার্বজনীন লুডো বোর্ড ছিল আমাদের । ঘুটি গুলো ছোট্ট ছোট্ট টোপর এর মত । তারপর অনেক বছর পেরিয়ে গেছে ছোটবেলা হারিয়েছি , এখন সম্ভবত যৌবন চলছে । সম্ভবত বলছি কারন ছেলেবেলা গেছে সেটা টের পেলেও বর্তমানকে বোঝার ক্ষমতা এখনও কিছু কম পরছে বলেই মনে হয়। যাইহোক এই খেলার সময় মানুষ গুলোর বয়স যেনো হাঁটুতে নেমে যায় এক লাফে । চলিত ভাষায় টিপ্পনী থেকে শুরু করে ঘুটি খাওয়া নিয়ে প্রায় চুলোচুলি , বোর্ড উল্টে দেওয়া, মজা হাসা হাসি এক অন্য পরিবেশ । বাইরে ততক্ষণে কতবার ফিসফিস বৃষ্টি ঝমঝমিয়ে নেমেছে বা ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি ফিসফিসিয়ে কমে এসেছে সেদিকে করো খেয়াল হয়না । এক সময় আবার বৃষ্টি আসে , সন্ধ্যা নামে ।
গ্রামে রাত নামে তাড়াতাড়ি । গ্রাম মানেই মেঠো পথ একে বেঁকে গেছে পুকুর পাড়, তাল তলা দিয়ে। অথবা বর্ষাকালে এক হাঁটু কাদা ভেঙে চাষী চলেছে বলদ নিয়ে , এরকম ভেবে ফেলার দরকার নেই । মাটির রাস্তা এখনও আছে কিছু ঠিকই, এমনকি সেখানে বর্ষা কালে গরুর খুড়ে গর্তও হয় । পুকুর, তাল গাছ সব আছে তবে ছেলেবেলায় সস্তার আর্টপেপারে জলরঙে আঁকা গ্রাম গুলো থেকে অনেকটাই আলাদা আমার এই গ্রামটা । সেরকমই গ্রামে রাত তাড়াতাড়ি নামলেও সব বাড়িতে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পরে না সবাই , কিছু জেগে থাকে । যাদের ভোরে উঠে কাজের তাগিদে ছুটতে হয় না । তবে বর্ষা কালের রাতের ছবি টা একটু আলাদায়। রাত নটার পর রাস্তা প্রায় শুনশান হতে শুরু করে। নদী ঘাটের চায়ের দোকান গুলোতে জনাকয়েক নেশাতুর লোক প্রেতাত্মার মত বসে ঝিমোয় । মাঝে মাঝে নদীর ওপর থেকে নৌকা নিয়ে যাওয়ার ডাক আসে । পাটনী ঢুলতে ঢুলতে নৌকা ঠেলে দিতে থাকে । আর মেরি বাগানের শেয়াল গুলো ডেকে ওঠে হুক্কা হুয়া হুয়া হুয়া ।
এখন এদিকে ইলেক্ট্রিসিটি সমস্যা করে না খুব একটা । ছোট বেলার দিন গুলোতে এরকম বর্ষা কালের রাত খুব একঘেয়ে লাগতো । ঘরের কোণে হ্যারিকেনের টিমটিমে আলো নেচে বেড়াতো আয়নার মধ্যে দিয়ে । পশ্চিমের জানালার সোজাসুজি পানা গর্তে জল পাওয়ার আনন্দে নেচে গেয়ে উঠত ব্যাঙের দল - ঘ্যাঙ ঘ্যাঙ ঘ্যাঙর ঘ্যাঙঙঙঙঙঙ । মাঝে মাঝে কি বিকট যে লাগতো সে উল্লাস, প্রকাশ করা মুশকিল । এখন আধুনিক যন্ত্র পাতি অনেক বেড়েছে ঘরে ঘরে , সেসবের মাঝে অতটা কানে আসে না ব্যাঙের কোলাহল । তবে তখন এই ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ এর সাথেই তাল দিয়ে আমি বসে যেতাম পুরনো কোনো পুজো সংখ্যা নিয়ে । হ্যারিকেনটা একটু বাড়িয়ে হলদে আলোতে হারিয়ে যেতাম গল্পের রাজ্যে । এবার সত্যি রাত বাড়ত আর ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে যেত গোটা গ্রাম নতুন ভোরের অপেক্ষায় ।
2 Comments
সুন্দর লেখা 💚
ReplyDeleteধন্যবাদ 😌
Delete